May 9, 2024

কথা হোক ঘরে বাইরে

পৃথিবী থেকে গত শতাব্দীতে বহু ভাষা নিশ্চিহ্ণ হয়ে গিয়েছে, পাশাপাশি অবলুপ্ত হওয়ার পথে বহু ভাষা। হিসাব জানাচ্ছে; পৃথিবীতে কিছুকাল আগে পর্যন্ত মোট ৪২ হাজার ১৯২টি ভাষার চর্চা ছিল, তার মধ্যে এখন বেঁচে আছে মাত্র ছয় হাজার ভাষা। যে হারে ভাষার মরণ হচ্ছে, তাতে আগামী ১০০ বছরে যত ভাষা টিকে আছে তার ৫০ শতাংশ হারিয়ে যাবে বলে মনে হচ্ছে।

তার চর্চার অভাবে পৃথিবী থেকে অনেক ভাষা হারিয়ে গিয়েছে। সংস্কৃত, লাতিন বা গ্রিক ভাষা প্রায় লুপ্ত হয়ে যাওয়ায় তেমন ক্ষতি হয়নি।কারণ, এই ভাষাগুলি অন্য ভাষা তৈরি করেছে অথবা অন্য ভাষায় ছড়িয়ে গিয়েছে। তাই ভাষাবিদরা ভাষার স্বাভাবিক মৃত্যু নিয়ে চিন্তিত হলেও আতঙ্কিত ভাষার অস্বাভাবিক মৃত্যু নিয়ে। কিন্তু একটি ভাষার মৃত্যুর জন্য যদি আরেকটি ভাষা কারণ হয় কিম্বা একটি ভাষার আক্রমণে আরেকটি ভাষা নিহত হয় বা সেই ভাষা আত্মহননের পথ ধরে,কিংবা সেই ভাষা বলা বা লেখা মানুষদের মৃত্যুর কারণে ভাষাটি হারিয়ে যায়, তাহলে সেই ক্ষতি আর পূরণ হয় না।আমাদের দেশের ৪২টি কথ্য ভাষা বিস্মৃতির অতলে ডুবে যেতে চলেছে। বিপন্ন ভাষাগুলির মধ্যে রয়েছে আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের গ্রেট আন্দামানিজ, জারোয়া, লুরো, মুয়োট, ওঙ্গে, পু, সানেন্যিও, সেন্টিলিজ, শম্পেন ও তাকাহান্যিলাং। রয়েছে মণিপুরের ৭টি ভাষা আইমল, আকা, কইরেন, লামগ্যাং, লাংরোং, পুরুম ও তারাও। এছাড়া ধীরে হলেও অবলুপ্তির পথে এগোচ্ছে হিমাচল প্রদেশের বাঘাতি, হান্ডুরি, পাংভালি ও সিরমাউদি ভাষা।সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান বলছে, ইতোমধ্যেই ৫০০টি ভাষা বিলুপ্ত। আগামী কুড়ি বছরের মধ্যে আরও ২২০টি ভাষা শহিদ হবে।ভাষা বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, পৃথিবীতে প্রতি দু’সপ্তাহে একটি করে ভাষার মৃত্যু ঘটছে।স্বাধীনতার এতগুলি বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরও ৯৭% ভাষা সংসদের কৌলীন্য থেকে বঞ্চিত। মাত্র ২–৩% ভারতীয় ভাষা সংসদে কথ্য ভাষার সম্মান নিয়ে উচ্চারিত হয়। কেন্দ্রীয় বাজেটে হিন্দি ভাষার কৌলীন্য রক্ষা করার জন্য একদিকে যখন বরাদ্দ বাড়তেই থাকে, তখন ইউনেস্কোর অনলাইনের ভাষা ভোটে প্রথম হওয়া মধুরতম বাংলা ভাষার ভাগ্যের ঝুলি শূন্য অবস্থাতেই পড়ে থাকে।বাংলা ভাষাকে এখনও সরকারি আনুকূল্যে দপ্তরের ভাষা করা যায়নি।

এখনও সমস্ত মাধ্যমের স্কুলগুলিতে বাংলাকে আবশ্যিক হিসেবে পড়ানোর উদ্যোগ নিতে আমাদের কার্পণ্য রয়ে যাওয়ায় তা বাস্তবায়িত হয়নি। অলচিকি লিপি জানা শিক্ষকের দেখা পাওয়া ভার। তাই সেই সঙ্কট এখনও দৈনিক সংবাদের পাতায় শিরোনাম হয়।প্রসঙ্গত, কিছুকাল আগে সরকারের কাছে মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রকের আমলারা একটা সুপারিশ জমা দিয়েছিলেন, সেখানে বলা হয়েছিল, আদিবাসী ছাত্রছাত্রীদের একটি বড় অংশ স্কুল–‌ছুট হয়ে যাচ্ছে ভাষার কারণে। নিজের ভাষার বইপত্রের অভাব ও আদিবাসী মানুষদের মুখের ভাষার শিক্ষকের অভাবে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ না করেই তারা স্কুল ছাড়তে বাধ্য হচ্ছে। এখনও অন্য প্রদেশ থেকে চাকরি করতে আসা ছেলেমেয়েদের বাংলা ভাষা না শিখলেও দিব্যি চলে যায়। যেটা অন্য প্রদেশে একেবারেই হয়না। বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ যদি কেবলমাত্র মান্যজনের উদ্বেগের স্তরে আনুষ্ঠানিকতায় স্থায়ী হয় তবে তো সে ভাষার মরণদশা আটকানো কঠিন।মানে দাঁড়ায়, প্রতি এক পক্ষে অন্তত একটি ভাষার মৃত্যু হতে পারে।

সৌরভ রক্ষিত
প্রতিবেদন কথা নিউজ