May 9, 2024

কথা হোক ঘরে বাইরে

চড়কের গাছকে পুরুষাঙ্গের আকৃতি বলেই ধরা হয়

চড়কগাছ পুকুর থেকে তুলে মোচবেন্ধে মাথায় ঘিকলা দিয়ে খাড়া করা হয়েছে, ক্রমে রোদ্দুরের তেজ পড়ে এলে চড়কতলা লোকারণ্য হয়ে উঠলো।

একজন চড়কী পিঠে কাঁটা ফুঁড়ে নাচতে নাচতে এসে চড়কগাছের সঙ্গে কোলাকুলি কল্লেমৈয়ে করে তাকে উপরে তুলে পাক দেওয়া

হতে লাগলো, সকলেই আকাশপানে চড়কীর পিঠের দিকে চেয়ে

রইলেন। চড়কি প্রাণপণে দড়ি ধরে কখন ছেড়ে পা নেড়ে ঘুরতে

লাগল।দে পাক দে পাকশব্দ কারু সর্ব্বনাশ কারু পৌষমাস।

চড়কের এই বর্ণনা পাই হুতোমএর নকশায়।বলা বাহুল্য এই বর্ণনা প্রাচীন কলকাতার চড়কের। অনেক পরে গ্রাম বাংলার চড়ক মেলার প্রসঙ্গ এসেছে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়েরপথের পাঁচালীঅপরাজিততে। অপু কাহিনিতে বিভূতিভূষণ চড়ক মেলা লেখেন, ‘…চড়কতলার মাঠের শেওড়াবন অন্যান্য জঙ্গল কাটিয়া পরিষ্কার করা হইয়াছে…’  সে চড়কে অপুদুর্গা গাজনের সন্ন্যাসীদের পিছনে পিছনে ঘুরে বেড়াত।

চড়ক বলতে সাধারনভাবে চক্র বা ঘুর্ণনকেই বোঝায় কিন্তু ওই ঘুর্ণন যে কী ভয়ঙ্কর বা সাঙ্ঘাতিক তা যারা চড়কের ছবি দেখেছেন তারাও জানেন। কিন্তু চামড়ায় বাণবঁড়শি বিঁধিয়ে ঝুলে থেকে ঘোরার কারণটা কী? অনেকেই অনেক কারণের কথা বলেন। কেউ ভারতীয় পঞ্জিকা অনুযায়ী চৈত্র সংক্রান্তির দিন সূর্যের যে অয়ন বা যাত্রা শুরু হয়, সেই আবর্তনের ছাপ লক্ষ্য করেছেন। যাই হোক না কেন, আসলে এটি একটি লোকউৎসব। ভূমিকেন্দ্রিক সভ্যতার এই  দেশে ফসলের উর্বরতা প্রার্থনা থেকে এই পুজোর উৎপত্তি বলে উল্লেখ আছে। উর্বরতা শুধু জমিতে নয়, ঘরেও। যে কারণে চড়কের গাছ যে আঙ্গিকে পোঁতা হয় তা পুরুষাঙ্গের আকৃতি বলেই ধরা হয়। জন্য চড়ক গাছ যেদিন পুকুর থেকে ওঠানো হয় সেদিন যেসব বিবাহিত মহিলাদের সন্তান হয় না তারাওই পুকুরে স্নান করেন সন্তানের আশায়। আর চড়ক ঘোরার বিষয়টি চান্দ্র মাসের পরিচয় বহন করে।

আধিপুরাণেরবর্ণনায়আছে, রাজাদক্ষেরএককন্যাছিলচিত্রা।তারনামানুসারেএকনক্ষত্রেরনামকরাহয়চিত্রা।নক্ষত্রচিত্রাথেকেচৈত্রমাসেরনামকরণ।তাইহিন্দুধর্মেচৈত্রমাসেরবিশেষস্থান।চৈত্রমাসেরশেষদিনদেশেরবিভিন্নস্থানেবসেবিধাতাকেতুষ্টকরারনানানআয়োজন।এরমধ্যেসবচেয়েঅভিনবওপ্রাচীনআয়োজনচড়কপুজো, সেইসঙ্গেমেলা।চড়কপুজোর ১০-১২ দিনআগেথেকেবিভিন্নএলাকারপূজারিদেরমধ্যে ৪০-৫০ জনসন্ন্যাসধর্মেদীক্ষিতহয়েবাড়িবাড়িগিয়েশিব-গৌরীসহনৃত্যগীতকরেমাগনকরেন।চড়কপূজাপর্যন্ততারাপবিত্রতারসঙ্গেসন্যাসব্রতপালনকরেওনিরামিষখায়, সারাদিনউপবাসপালনকরে।

চড়ক পুজো মূলত নীল পুজো নামেই পরিচিত। গম্ভীরা বা শিবের গাজন এই চড়ক পুজোরই রকমফের। চড়ক পুজো চৈত্রসংক্রান্তিতে অর্থাৎ চৈত্র মাসের শেষ দিবসে পালিত হয়। পতিত ব্রাহ্মণ পুজোর পুরোহিতের দায়িত্ব পালন করেন। পুজোর বিশেষ অনুষঙ্গ হল শিবের পুজো। একটা সাজানো কাঠ তাতে লালসালু প্যাঁচানো, সিঁদূর মাখানো থাকে মাথার দিকটায়। এই পাট বা শিবকে একজন মাথায় নেয় আর বিভিন্ন বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়ায়। এর সামনে কোন গর্ভবতী মহিলা পড়লে তার বিপদের আশঙ্কা থাকে বলে মনে করা হয়।এসব পুজোর মূলে রয়েছে ভূতপ্রেত পুনর্জন্মের ওপর বিশ্বাস। এর বিভিন্ন অনুষ্ঠান প্রাচীন কৌমসমাজে প্রচলিত ছিল।এই পুজোতে বা

উৎসবে বহু ধরনের দৈহিক যন্ত্রণা ধর্মের অঙ্গ বলে বিবেচিত হয়।

১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ সরকার আইন করে এই নিয়ম বন্ধ করলেও গ্রামের সাধারণ লোকের মধ্যে এখনো তা প্রচলিত রয়েছে। আধুনিকতার অভিঘাতে ঐতিহ্যবাহী মেলাগুলির চারিত্রিক পরিবর্তন হচ্ছে। তারপরও মেলা শ্রেণিহীন উৎসব। এর কোনো বিকল্প নেই। গ্রাম বংলার মেলার এই আবেদন মনে হয় শেষ হওয়ার নয় কখনো।