আমাদের খাদ্য সংস্কৃতিতে পান্তা খাওয়ার ইতিহাস অতি প্রাচীন। যদিও রামায়ণে দেখা যায়, সীতা রামকে পোলাও রান্না করে খাওয়াচ্ছেন। তবে সেই যুগের ঋষি–মুনিরা যে কেবল পোলাও কিংবা অষ্টব্যঞ্জন দিয়েই আহার করতেন তাও নয়, পান্তাও খেতেন।হাজার বছর আগে এ দেশে কাঁচা লঙ্কা ছিল না, তখন পান্তা খাওয়া হতো চিংড়ি চচ্চড়ি, মৌরলা মাছের ঝোল কিংবা বেগুন পোড়া দিয়ে। আমাদের দেশে কাঁচা লঙ্কার আগমন ১৫০০ সাল নাগাদ পর্তুগিজ নাবিক ভাস্কো–দা–গামার হাত ধরে। সম্রাট শাহজাহানের আমলে দেশের নানা জায়গায় লঙ্কার ব্যবহার ছড়িয়ে পড়ে। তার আগে পর্যন্ত ব্যঞ্জনগুলিতে ঝালের পরিপূরক হিসেবে গোলমরিচ, পিপলু আর আদা ব্যবহৃত হতো।
বাঙালির পান্তাভাত বা ভাতে জল ঢেলে খাওয়ার অভ্যাস থেকে বোঝা যায় যে তাদের জীবনাচরণ কতটা সাধারণ ছিল। কেবল তাই নয় তাদের অপচয়বিরোধী মনোভাবেরও পরিচয় মেলে। সেই সঙ্গে জ্বালানি বাঁচানোর মতো সচেতন বিষয়টিও চিল। গ্রামের পাঠশালায় যাওয়া ছাত্র বা কৃষিজীবী মানুষের পান্তা খেয়ে কাজ শুরু করার প্রথা কিছু দিন আগে পর্যন্তও আমরা দেখেছি।
পূর্ব ও পশ্চিম– দুই বঙ্গের বাঙালির আগের দিন রান্না করা ভাতে জল ঢেলে পান্তা তৈরি করার বিশেষ রীতি আছে। বরিশাল জেলায় এই ভাতকে বলে ‘পসুতি’ ভাত। পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলায় গরম ভাতে জল ঢেলে রাখলে তাকে বলা হয় ‘পোষ্টাই’ ভাত। এই ভাত খেলে নাকি পেট ঠাণ্ডা হয়। দুর্গা–পুজোর দশমীর দিন সকালে দেবী দুর্গাকে পান্তাভাত আর কচুর শাক নিবেদন করে বাঙালি হিন্দুরা তাদের প্রিয় দেবীকে বিদায় জানায়। এর পেছনে অবশ্য মজার একটি মিথ চালু আছে– দুর্গাপুজো উপলক্ষে মেয়েরা সাধারণত তাদের বাপের বাড়ি আসেন। দুর্গাপুজোর তিনদিন ধরে বাপের বাড়িতে তারা নানা সুস্বাদু ব্যঞ্জন দিয়ে মহাভোজ করেন কিন্তু সেই কথা স্বামীর কাছে গোপন রাখার জন্যই দেবী বিদায়ের দিনে তারা কচুর শাক দিয়ে পান্তা খান। আর স্বামীর কাছে গিয়ে বলেন, দরিদ্র পিতা তার কন্যাকে এর চেয়ে বেশি কিছু আহার করাতে পারেননি। যাতে করে এ কথা শুনে তার স্বামী সারা বছর তাকে ভালো–মন্দ খাওয়ান।
বাঙালিরর প্রিয় কবি রবীন্দ্রনাথও পান্তা খেতে পছন্দ করতেন, বিশেষ করে তাঁর নতুন বউঠান কাদম্বরী দেবীর হাতের পান্তাভাত ও সঙ্গে চিংড়ি মাছের চচ্চড়ি। রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনস্মৃতি গ্রন্থে লিখেছেন– ‘ইসকুল থেকে ফিরে এলেই রবির জন্য থাকে নতুন বউঠানের আপন হাতের প্রসাদ। আর যেদিন চিংড়ি মাছের চচ্চড়ির সঙ্গে নতুন বউঠান নিজে মেখে দেয় পান্তাভাত, অল্প একটু লঙ্কার আভাস দিয়ে সেদিন আর কথা থাকে না।’ কবি পান্তাভাতের বিষয়টি তাঁর সাহিত্যেও টেনে এনেছেন । বিশেষ করে তার ‘রামকানাইয়ের নির্বুদ্ধিতা’ গল্পে আমরা পান্তাভাত খাওয়ার বর্ণনা পাই। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কিংবা পল্লীকবি জসীমউদ্দীনকে ছাত্রাবস্থায় পান্তা খেতে হয়েছে অভাব–অনটনের কারণে।
পান্তাভাত নিয়ে বাংলায় গল্প–কথার শেষ নেই।তেমনি পান্তার পুষ্টিগুণ নিয়ে ডায়েটিসিয়ানরাও অনেক কথা বলেন।পান্তা নিয়ে তাদের মতামতে কিন্তু ফারাক নেই বললেই চলে। ভাত আর জল দুয়েই রয়েছে প্রায় আশি থেকে পঁচাশি শতাংশ পুষ্টিগুণ। তবে কোনো খাবারই তো বেশি খাওয়া ভাল নয়। তাই পান্তা পরিমিত খাওয়ার কথাই বলেন তারা।ডায়েটিসিয়ানরা বলেন, ‘পান্তাতে জল থাকে এটা শরীর ও পেট ঠাণ্ডা রাখে। বেশিক্ষণ গাঁজানো হয় বলে এতে ক্যালরি ও কার্বন ডাইঅক্সাইড বেড়ে যায়।
এই কারণে খেয়াল রাখতে হবে, পান্তা যেন খুব বেশি সময় ভিজিয়ে রাখা না হয়। বেশি সময় জলে ভিজিয়ে রাখা পান্তায় একটা টক ভাবে আসে। সেটা শরীরের পক্ষে খুব ক্ষতিকারক না হলেও ভেজান জল–ভাত যত বেশিক্ষণ ভিজবে তার মধ্যে টক্সাইড কাজ করতে থাকবে, ফলে তা ক্রমশ পচতে শুরু করবে। সেই পচনশীল ভাত বা জল শরীরের পক্ষে উপকারী হবে না। অন্যথায় পান্তা পুষ্টিগুণে ভরপুর।
ভাতে ৭৮ গ্রাম শ্বেতসার, ৬.৮ গ্রাম প্রোটিন, ০.৫ গ্রাম স্নেহ্ ৩৪৫ ক্যালরি, ১০ মি. গ্রা ক্যালসিয়াম ও ২.০২ মি.গ্রা বি–ভিটামিন থাকে।ভাতকে পান্তায় রূপান্তরিত করার পরও ওইসব পুষ্টিগুণ একই রকম থেকে যায়।
কালের বিবর্তনে একাধিক সংস্কৃতির বহু কিছু গ্রহণ বর্জনে আমাদের মূল সংস্কৃতির বেশ কিছু রদ বদল ঘটেছে। ইতিহাসের জন্মকাল থেকে যে দেশের প্রথম ও প্রধান উৎপন্ন ফসল ধান, সে দেশে প্রধান খাদ্য যে ভাত হবে এটাই স্বাভাবিক! ভাত খাওয়ার এই অভ্যাস ও সংস্কার আদি–অস্ট্রীয় জনগোষ্ঠীর সভ্যতা ও সংস্কৃতির দান! সমাজের উচ্চবিত্ত থেকে নিম্নবিত্ত সমস্ত স্তরের মানুষের প্রাধান খাদ্য ছিল ভাত, হয়ত রান্নার পদ্ধতিতে কিছুটা ফারাক থাকতো।তবে পান্তা আমাদের বাঙালি খাদ্যাভ্যাসে ছিল এমন রীতির কথা কিন্তু কোথাও পাওয়া যায় না।
More Stories
ভারত পাকিস্তান বর্ডারে মোদি I পাকিস্তানের ঘুম উড়লো
এগিয়ে আসছে ঘূর্ণিঝড় দানা I ধীরগতির জন্য চিন্তায় আবহাওয়াবিদরা
এথিক্স ব্রেক করছেন কি ডাক্তারবাবুরা ?