কর্ণফুলী নদীর ধারে নয়াপাড়া নামে একটি গ্রাম। সেই গ্রামে ছেলেটির জন্ম। যখন ছেলেটি ইস্কুলে পড়ে তখন সে তাঁর মাস্টারমশাইয়ের ঘরের দেওয়ালে টাঙানো একজনের ছবি দেখতো, বিদ্যাসাগরের ছবি। শুনত মাষ্টারমশায় গলা ছেড়ে আবৃত্তি। নবীনচন্দ্র সেনের কবিতা। ছেলেটির ভাল লাগত সেইসব কবিতা। ছেলেটি এরপর নয়াপাড়া গ্রাম ছেড়ে পড়তে আসে চট্টগ্রাম শহরে। সেই সময় তাঁর হাতে আসে সখারাম গণেশ দেউস্করের ‘দেশের কথা’, বঙ্কিমের ‘আনন্দমঠ’ প্রভৃতি বই। সেগুলি ছেলেটি মন দিয়ে পড়ে। এরপর স্কুল শেষ হয়। ছেলেটি এসে ভরতি হয় ভাগীরথীর তীরে কৃষ্ণনাথ কলেজে। পড়ার পাশাপাশি ছেলেটি বন্ধুদের সঙ্গে ছুটে যেত বন্যাবিধ্বস্ত এলাকায়। ঝাঁপিয়ে পড়েত বন্যাত্রাণে।
পড়াশুনা শেষ করে ছেলেটি এরপর শিক্ষক হিসাবে যোগ দিলেন উমাতারা উচ্চ বিদ্যালয়ে। ছাত্রদের মুখে মুখে হয়ে উঠলেন ‘মাস্টারদা’। কলকাতার ওয়েলিংটন স্কোয়ারের গোপন আস্তানায়। শরৎচন্দ্রের ‘পথের দাবী’ সেই সময় ‘ভারতী’তে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে। মাস্টারদা গুপ্ত আস্তানায় হ্যারিকেনের আলোয় রাত জেগে পড়তেন সেই লেখা। একদিন গ্রেফতার হয়ে চালান হয়ে গেলেন রত্নগিরি জেল। সেখানেও মাস্টারদা শরৎচন্দ্রের ‘পথের দাবী’-র কথা খুব বলতেন। এও বলতেন, মহৎ সাহিত্য মনকে সজীব রাখে। এ সব বই ভালর প্রতি লোভ জন্ম দেয়। ব্রিটিশ সরকার ১৯৩৪ সালের ১২ জানুয়ারি ইন্ডিয়ান পেনাল কোড ১২১/১২১এ ধারা অনুযায়ী সূর্যসেনের বিরুদ্ধে স্পেশাল ট্রাইব্যুনালের মামলায় মাষ্টারদাকে ফাঁসিতে ঝোলায়।
তার আগে ব্রিটিশ পুলিশ আঘাতে আঘাতে মাষ্টারদা’র সব দাঁত উপড়ে নিয়েছিল। আসলে ব্রিটিশ ফাঁসি দিয়েছিল মাষ্টারদার রক্তাক্ত ক্ষত-বিক্ষত অচৈতন্য দেহ। ব্রিটিশ সূর্য সেনকে কনডেম্ড সেলে কড়া পাহারায় রাখতে বাধ্য হয়েছিল। সেখান থেকেও মাষ্টারদা কয়েদি মেথর মারফত জেলের বিভিন্ন ওয়ার্ডে বন্দী বিপ্লবীদের কাছে চিঠি পৌঁছে দিতেন। জেলে মাষ্টারদার একদিন গান শোনার খুব ইচ্ছা হয়। তাঁর সঙ্গে অন্য সেলে ছিলেন বিপ্লবী বিনোদ বিহারী চৌধুরী, মেয়েদের সেলে ছিলেন কল্পনা দত্ত। একদিন রাত ১১টা/১২টা নাগাদ কল্পনা দত্ত বিনোদবিহারীর উদ্দেশে চিৎকার করে বলেন, ‘বিনোদ শুনতে পাচ্ছিস, দরজার কাছে আয়। ওরে মাষ্টারদা গান শুনতে চাইছেন রে’। বিনোদবিহারী গান জানতেন না। তাহলে কি মাষ্টারদার ইচ্ছে পূরণ করা যাবে না। শেষ পর্যন্ত ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে” গানটা গেয়ে শোনালেন বিনোদবিহারী। আমরা বন্ধুরা এগিয়ে চল, কখনো পিছিয়ে যেও না। পরাধীনতার অন্ধকার কিন্তু ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে। স্বাধীনতার নবারুণ দেখা যাচ্ছে। তাই হতাশ হয়ো না। সাফল্য আমাদের হবেই। মৃত্যু নিশ্চিত জেনে হয়ত তিনি কষ্ট পাচ্ছিলেন, জীবনের মায়া তাকে হয়ত আরও জড়িয়ে ধরছিল, কিন্তু সেই মুহুর্তেও তিনি তাঁর দেশের স্বাধীনতার স্বপ্ন থেকে এক বিন্দু সরে যান নি, সঙ্গীদের সেই স্বপ্নে বিভোর থাকতে অনুরোধ করেছিলেন।
More Stories
ভারত পাকিস্তান বর্ডারে মোদি I পাকিস্তানের ঘুম উড়লো
এথিক্স ব্রেক করছেন কি ডাক্তারবাবুরা ?
সুপ্রিম কোর্টের শুনানি I R G KAR – খুন ধর্ষণ মামলা#supremecourt