November 21, 2024

কথা হোক ঘরে বাইরে

সংবাদমাধ্যমের বিরুদ্ধে তদন্তকারী সংস্থা লেলিয়ে দিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। গত বছরে বিবিসি থেকে নিউজলন্ড্রী, দৈনিক ভাস্কর থেকে ভারত সমাচার, দ্যা ওয়ার, দ্যা কাশ্মীরওয়ালা এবং সব শেষে নিউজ ক্লিকের বিরুদ্ধেও একই পদক্ষেপ নেওয়া হল। কেন এই পদক্ষেপ? এসব যে সংবাদমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

প্রসঙ্গত, ২০১৭ সালে সাংবাদিক গৌরী লঙ্কেশের হত্যাতে সারা দেশ নড়েচড়ে উঠেছিল। রাতের অন্ধকারে আততায়ীরা নির্ভীক বর্ষীয়ান সাংবাদিককে তাঁর বাড়ির সামনেই গুলিতে ঝাঁজরা করে দেওয়া হয়। গৌরী লঙ্কেশ দীর্ঘদিন ধরেই কেন্দ্রীয় সরকারের চক্ষুশূল হয়ে উঠেছিলেন, তাঁর লঙ্কেশ পত্রিকায় তথ্যনির্ভর সরকার বিরোধী সংবাদের জন্য। কিন্তু এটা একেবারেই ভাবা যায়নি যে তার জন্য একজন সাংবাদিককে নিজের জীবন দিতে হবে। সাংবাদিক হত্যা ভারতে নতুন বিষয় নয়। তাই ধর্মান্ধ, আধিপত্যবাদী এবং দেশকে পুঁজিপতিদের হাতে বিক্রি করে দেওয়া সরকার বিারোধী মতের জন্য সাংবাদিকদের হত্যা করতে যে দ্বিধা করবে না তা গৌরীকে দিয়েই বুঝিয়ে দিয়েছিল। সে দিন থেকে বোঝা গিয়েছিল যে সরকার, সংবাদ মাধ্যমের টুঁটি চেপে ধরছে। সেখান থেকে আমরা অঘোষিত জরুরি অবস্থা সামনে দাঁড়িয়ে পড়েছি।

কারণ, ২০১৪ থেকে যে সাম্প্রদায়িক দলটি কেন্দ্রে ক্ষমতায় এবং তাদের অনুপ্রেরক ধর্মীয় সংগঠনটির একমাত্র লক্ষ্য ভারতের মতো একটি বহু ধর্মের, বিবিধ ঐতিহ্যের দেশকে হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করা, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের উপর বর্বর আক্রমণ চালানো, প্রান্তিক গোষ্ঠীর মানুষদের দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দেওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি করা, দেশের দরিদ্র জনসংখ্যাকে আরও দরিদ্র করে দেওয়া, দেশের স্বাধীনতার পর থেকে গত সাত বছরে যে পরিমাণ অর্থনৈতিক, সামাজিক অবনমন ঘটেছে তা ভাবা যায়নি।

১৯৭৫ সালের জরুরি অবস্থাকালীন সময় থেকেই সেটা স্পষ্ট যে দেশে একনায়কতন্ত্র না থাকলেও রাষ্ট্র তার সবটুকু ক্ষমতা প্রয়োগ করে আইনের ফাঁক গলে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া থেকে কোনওটাতেই পিছপা হয়নি। আর এখন অঘোষিত জরুরি অবস্থার সময়েও তারই পুনরাবৃত্তি ঘটে চলেছে।

১৯৭৫এর ২৫ জুন জরুরি অবস্থার এতগুলি বছর পেরলো, কিন্তু কী আশ্চর্য সেই অতীতেরই প্রতিরূপ হয়ে উঠেছে আজকের ভারত। যেন অঘোষিত জরুরি অবস্থা চলছে দেশ জুড়ে। দেশদ্রোহী, দেশবিরোধী তকমা জুটে যাওয়া এখন আর নতুন কিছু নয়। কোনো কোনো বিষয়ে মত প্রকাশ করলে রাষ্ট্রের রক্তচক্ষু এড়ানো সম্ভব নয়। যদিও সংবাদমাধ্যম গত কয়েক বছরে আমূল বদলে গিয়েছে। সংবাদমাধ্যমের উপর রাষ্ট্রের ক্ষমতার আস্ফালন আরও বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। দেশের সব সংবাদমাধ্যম নয়, সব সাংবাদিকও নয়, কিন্তু অধিকাংশই আর কোনওভাবে রাষ্ট্র, সরকার, প্রশাসন কাউকেই চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলতে চায় না, রাগাতে চায় না। কারণ সাংবাদিকতার থেকেও মুনাফার আকর্ষণ অনেক বেশি। সরকারি বিজ্ঞাপন থেকে বঞ্চিত হয়ে লাভ নেই। অন্যদিকে সংবাদ মাধ্যমের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা যেমন ১৯৭৫ সালে ইন্দিরা সরকার জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে নির্দয়ভাবে কেড়ে নিয়েছিলেন, ৭০০০ সাংবাদিককে আটক করে জেলে পুরেছিলেন, এখন আর সেই অবস্থাটি নেই। এখন নিশ্চিতভাবেই সংবাদ প্রকাশের মাধ্যম অনেক বেশি হয়ে গিয়েছে, সেই কারণেই তীব্র হয়েছে রাষ্ট্রের নজরদারি এবং সাংবাদিকদের উপর আক্রমণ। পুলিশ প্রশাসন দেশের বিচারব্যবস্থা কেন্দ্রে ক্ষমতায় থাকা সরকারের সঙ্গে সঙ্গত করছে। কোনও ঘোষিত প্রেস অ্যাডভাইসার নেই, কিন্তু রয়েছে শাসকদলের হিতাহিতজ্ঞানশূন্য সমর্থকেরা। যারা সাংবাদিকের ক্যামেরা থেকে কলম, সম্মান, প্রাণ কেড়ে নিতে দ্বিধা করছে না। সত্যনিষ্ঠ সাংবাদিকতার বিপ্রতীপে তারা দাঁড় করাতে চাইছে ফেক নিউজএর কারবারকে।

সেই কারণেই প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা রাজনৈতিক দুরাবস্থার মধ্যেও বিজেপি সরকারের দাঁতনখ বেরিয়ে পড়েছে। কিন্তু দেশের নাগরিকেরা সংবাদ মাধ্যমের তফাৎটা বুঝতে পারছেন, ফেক নিউজ কীভাবে হিংসা ছড়াতে পারে সে বিষয়েও ধারণা তৈরি হয়েছে। অন্যদিকে কিছু সাংবাদিকের পেশাদারি, সাংবাদিকতার প্রচেষ্টা রাষ্ট্রকে সম্ভবত ভয় পাইয়ে দিচ্ছে। সেইজন্যই কেন্দ্র সুযোগ বুঝে সংবাদমাধ্যম বা সাংবাদিকদের উপরে প্রতিশোধ নেওয়ার খেলায় মেতেছে। কাশ্মীরে ৩৭০ রদ, ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করা শুধু সাধারণ মানুষকে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে রাখাই নয়, সংবাদ সংগ্রহ সংবাদ প্রকাশ বন্ধের কফিনে শেষ পেরেক। যেহেতু অনলাইনে এখনও পর্যন্ত কোনওরকম সেন্সরশিপ করা সম্ভব নয়, তবু সেক্ষেত্রেও সাংবাদিকেরা নির্দিষ্ট সময়ের পর কাজে বাধা পাওয়া, আতঙ্কিত হয়ে কাজ না করা ইত্যাদির মধ্যে দিয়ে চলেছেন।